Thu, Mar 26th, 2009 2:11 am BdST

অ্যান্থনি মাসক্যারেনহাস

রাত আটটার দিকে একটা রিকশা দ্রুতগতিতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির সামনে থামলো। রিকশাঅলাটি তখন ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে লোকটা জানালো ঝাড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে রিকশা চালিয়ে এসেছে সে। তার কাছে ছিল বঙ্গবন্ধুকে লেখা একটা চিরকুট যাতে বলা হয়েছে: আপনার বাড়িতে আজ রেইড হতে পারে।

ওই সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন আমাকে বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আসন্ন রাতের ‘অ্যাকশন’ সম্পর্কে তাদের কাছে এটাই ছিল প্রথম সুনির্দিষ্ট আভাস। সেদিনই সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বিনা নোটিশে ঢাকা ত্যাগ আওয়ামী লীগ শিবিরে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এরপর সেনাবাহিনীর সন্দেহজনক গতিবিধি দেখে শেখ মুজিব তার সহযোগীদের সতর্ক হতে এবং আত্মগোপনে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকতে বলেন। বঙ্গবন্ধু নিজে পালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান।

এর পর থেকে তাকে দেখতে পেয়েছেন হাতে গোনা কয়েকজন।
বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের কেউ কেউ প্রায় আধঘন্টা পর পর ফোন করেছেন তার অবস্থা জানতে। বাড়ির কাজের লোকটি ফোন ধরে প্রতিবার তাদের আশ্বস্ত করেছে। কিন্তু গুলির আওয়াজে চারদিক প্রকম্পিত আর আগুনের শিখায় রাতের আকাশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠার আড়াই ঘন্টা মত পরে বঙ্গবন্ধুর ফোন ডেড হয়ে গেলো। আতঙ্কিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো, বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর কব্জায়।

এর সপ্তাহতিনেক পর আমাকে ঘটনাটির বর্ণনা দেন এক প্রতিবেশী। তিনি আমাকে বাড়ির দেয়ালে গুলির চিহ্নও দেখালেন।

প্রত্যক্ষদর্শী এই প্রতিবেশীর ভাষ্যে, রাত দেড়টার দিকে দুটি সেনা জিপ ৩২ নম্বরের সামনে এসে থামে। পেছনে কয়েকটি ট্রাক। কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির বাগান ভরে গেলো সৈন্যে। ছাদের দিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় তারা। গুলি করা হয় ওপর তলার একটি জানলা লক্ষ্য করেও।

প্রতিবেশীটি আমাকে জানালেন, আক্রমণ নয় সেটা ছিল স্রেফ ভীতি প্রদর্শন। এই তাণ্ডবের মধ্যে তিনি শুনতে পান, ওপর তলার এক বেডরুম থেকে বঙ্গবন্ধুর গলা: “তোমরা এরকম বর্বর আচরণ করছো কেন? তোমরা আমাকে বললে আমিই নিচে নেমে আসতাম।”

পাজামার ওপর একটি মেরুন ড্রেসিং গাউন চাপিয়ে বঙ্গবন্ধু নেমে এলেন নিচে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল এক তরুন ক্যাপ্টেন। আমার তথ্যদাতার বক্তব্য অনুযায়ী সে ছিল বিনয়ী ও আন্তরিক। ক্যাপ্টেন বললো, “আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে স্যার।”

তারা বঙ্গবন্ধুকে তুলে নিয়ে চলে গেলো।

শেখ মুজিবের স্ত্রী ও শিশু সন্তানরা পাশের এক বাড়িতে পালিয়ে যান। এর ঘন্টাখানেক পর এলো একটি সেনা ট্রাক। এবার আর ভদ্রতার বালাই ছিল না সৈন্যদের মধ্যে।

নিচতলার ঘরের সব জানলা-দরজার কাচ ভেঙে গুড়িয়ে দিলো তারা। ঘরের আসবাব ভেঙে বিছানাপত্র ,বইয়ের আলমারি উল্টে তুলকালাম করলো। দেয়ালে টাঙানো ছবি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হলো। মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ছবি ছিল চেয়ারম্যান মাও সেতুংয়ের। রূপালি ফ্রেমে বাধানো ছবিটা তার স্বাক্ষর করা। কোত্থেকে পেলেন ছবিটা বঙ্গবন্ধু, ভাবছিলাম আমি। সৈন্যরা শুধু তল্লাশি চালাচ্ছিল তা নয়। তারা যেন কোনো শত্র”র ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল, যেমন করে সামনের গাছকেই আক্রমণ করে আহত বাঘ।

এপ্রিলের মাঝামাঝি আমি নিজে বাড়িটাতে গেলে ওই তাণ্ডবের চিহ্ন নিজের চোখেই দেখি। বাড়িটায় প্রাণের চিহ্ন বলতে ছিল একটি ছাইরঙা বড়সড় বিড়াল যে কিনা আমাদের দেখে বেরিয়ে এসে শান্তচোখে তাকিয়ে রইলো। বাড়ির পেছনে খাঁচার মধ্যে দশ-বারোটি কবুতর আর উঠোনে চরছে তিনটি মুরগি।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যে হানাবাড়ির নিঃসঙ্গতা আমি দেখেছি তা পরেও অসংখ্যবার চোখে পড়েছে গোটা পূর্ব বাংলা জুড়ে- বাড়ির পর বাড়ি, আস্ত গ্রাম আর শহর-জনপদ খা-খা করছে, সব মানুষ পালিয়ে গেছে প্রাণভয়ে।

ভাগ্য ভালো যাদের তারা পালিয়ে যেতে পেরেছে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে। অনেক সময় নিঃসম্বল হয়ে কেবল প্রাণটি হাতে করে। মুজিবের মতো বাকিরা পাকড়াও হয়ে চলে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। আর রয়েছে সেইসব হতভাগ্য যাদের ফুলে ওঠা লাশ চোখে পড়বে যত্রতত্র। বেয়নেটের খোঁচা আর বুলেটের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত দেহগুলো পড়ে আছে মাঠ-ঘাট খানাখন্দে কিংবা মৃদু বাতাসে দুলতে থাকা নীরব নারকেল বীথির ফাঁকে ফাঁকে।

ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিরাপদে করাচী নামার সংকেত পেয়েই মাঠে নামে ২৫ মার্চের রাতে। তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। মধ্যরাত নাগাদ সৈন্যদের নারকীয় তাণ্ডব অনেকখানি এগিয়ে গেছে। পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের দপ্তরে হামলা হলো ট্যাংক, বাজুকা আর অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হলো একই অভিজ্ঞতা। একই সময়ে। এ দু’জায়গা মিলিয়ে হাজার পাঁচেক অপ্রস্তুত বাঙালি হাতের কাছে যা পেলো তা নিয়েই কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলাফল যে কী হবে তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহের অবকাশ ছিল না। সেনাবাহিনীর সুবিধা ছিল একাধিক: প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত পাওয়া, সৈন্য সংখ্যা এবং বহুগুণে শক্তিশালী অস্ত্র সামর্থ্য। তবে বাঙালি সৈনিকরা প্রাণ দেওয়ার আগে পাকিস্তানী সৈন্যদের চরম বেগ দিয়েছে। অন্তত পরে আমাকে বিধ্বস্ত এলাকাগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর সময় গাইড তাই বলেছে।

নগরীর অন্যান্য স্থানে সৈন্যের দল বাজুকা, ফ্লেম থ্রোয়ার (আগুন লাগানোর অস্ত্র), মেশিন গান ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেলে সজ্জিত হয়ে আগে থেকে ঠিক করা টার্গেটের ওপর চড়াও হচ্ছিল। কখনো তাদের সঙ্গে ছিল ট্যাংকও। একটি দল গেলো আওয়ামী লীগ সমর্থক পত্রিকা ‘দি পিপল’ অফিসের দিকে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের টেরাসে জড়ো হওয়া আতঙ্কিত বিদেশী সাংবাদিকদের চোখের সামনেই ঘটছিল ব্যাপারটা। সরু গলিটায় ঢুকে সৈন্যরা খুব কাছ থেকে গুলি চালালো। যেসব কর্মী পালাতে চেষ্টা করেছিলো তারা নির্মমভাবে কচুকাটা হলো। গোলাগুলির পর ভবনটার যা বাকি থাকলো তাতে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এভাবেই সেনাবাহিনীর একটা ‘শত্র”‘ শেষ হলো।

শহরের অন্য মাথায় শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের একই পরিণতি হলো। পরে ‘ভুল বুঝতে পেওে’ সেনাবাহিনী অফিসটা সংস্কার করে। একটা পুরনো ছাপাখানা যোগাড় করে কাগজটা আবার চালু করা হয়।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ও স্টাফ কোয়ার্টারগুলিতে যে শতশত ছাত্র আর তাদের শিক্ষককে নিধন করা হলো তাদের জন্য শোক করার কেউ ছিল না। সবার অলক্ষ্যেই যেন শাঁখারিপট্টি, তাঁতীবাজার ও রমনা রেসকোর্সের মন্দিরের আশেপাশে থাকা অনেক হিন্দুকে হত্যা করা হলো। শাঁখারিপট্টিতে হত্যা করা হয় আট হাজারের মতো হিন্দু নারী,পুরুষ আর শিশুকে। রাস্তার দুই মাথা বন্ধ করে দিয়ে সৈন্যরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিধন করে তাদের।

নিউ মার্কেটের অদূরে লেঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়িতে হানা দিল সৈন্যরা। নৌবাহিনীর সাবেক এ অফিসার আওয়ামী লীগের একজন পরিচিত নেতা এবং ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অন্যতম অভিযুক্ত। স্ত্রীর চোখের সামনে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে খুন করা হলো তাকে।

পাক হানাদার বাহিনীর আক্রোশের বিশেষ টার্গেট ছিল ইকবাল হল এবং তার নিকটবর্তী জগন্নাথ হল। ইকবাল হল মুসলমান আর জগন্নাথ হল হিন্দু ছাত্রদের আবাসস্থল ছিল। সেনাবাহিনী এ দুটি হল ঘেরাও করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ছাত্রদের হত্যা করে। হল কম্পাউণ্ডের বাইরে তড়িঘড়ি গর্ত খুঁড়ে হিন্দু ছাত্রদের মাটিচাপা দেওয়া হয়। ইকবাল হলের মুসলমান ছাত্রদের মৃতদেহগুলো সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয় অথবা এলোপাতারি ফেলে রাখা হয়। হলের ছাদেও অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়।
সেই কালরাতে ঢাকায় ৪৮ ঘন্টা ধরে চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা। ২৬ মার্চ ভোরবেলা কথিত ‘কারফিউ ভঙ্গের’ অভিযোগে মাত্র কয়েকঘন্টায় কয়েকশ’ নিরীহ বাঙালির ওপর গুলি চালানো হয়, যদিও কারফিউ জারির কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি। পরে সকাল দশটার দিকে কারফিউ জারি করা হলো। আর তা করা হয় সবাইকে ঘরে আটকে পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যস্থলে অভিযান চালানোর উদ্দেশ্যে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত ওই গণহত্যা ছিল ‘শুদ্ধি অভিযান প্রক্রিয়া’, সেনাশাসকরা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হিসেবে যে শুদ্ধি অভিযানকেই বেছে নিয়েছিল।

কুমিল্লায় পাকিস্তান আর্মির ১৬ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে আমাকে খোলাখুলিভাবেই বলা হয়েছিল: “পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার হুমকিকে আমরা চিরতরে সমূলে বিনাশের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর, এমনকি তার জন্য যদি ২০ লাখ মানুষকে হত্যা এবং প্রদেশটিকে ৩০ বছর ধরে উপনিবেশ হিসেবে শাসন করতে হয় তাহলেও আমরা তা করবো।”

আর সামরিক শাসকদের কাছে এটাই ছিল পূর্ববাংলার সমস্যার ‘চূড়ান্ত সমাধান’। হিটলারের পর আর এত নারকীয় ঘটনা ঘটেনি।

* অ্যান্থনি মাসক্যারেনহাসের ‘দি রেপ অব বাংলাদেশ’ গ্রন্থ থেকে। অনুবাদ হুমায়ুন হাশিম

ভায়েরা আমার,
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা
আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার
ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।
আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।
কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন।
আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো।
এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের
রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস- এদেশের মানুষের
রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে
আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা আন্দোলনে
৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে
যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন – আমরা মেনে
নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো।
আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা
হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার
কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম,
ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও
বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে
নেব।
জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো
আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ
করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো।
তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে
যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে
বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব
বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া
হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ
প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ
করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে
যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
কি পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই
অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি।
আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর
ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের
প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কি
করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার
করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে।
আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত
নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি
করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।
ভায়েরা আমার,
২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের
ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা।
এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত
সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর
জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে
পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।
আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।
আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।
গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর
হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা,,ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু সেμেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট,
হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।
২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে,
আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় – তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে
তোল।
তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু –
আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো।
তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি
চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ
আমাদের দাবাতে পারবেনা।

আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য
করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন
হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন।
সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স
বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না।
মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দুমুসলমান,
বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের
যেন বদনাম না হয়।
মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও
স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক
খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান
হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে
আপনারা চালাবেন।
কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন।
প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল−ায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে,
তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইন্শাআল্লাহ্।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।

ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার

জানুয়ারি ১৯৭২

১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বিদেশী সাংবাদিক হিসাবে সম্ভবত প্রথম একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন বিবিসির তৎকালীন সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট। সাক্ষাৎকারের পুরোটা সময়ই বঙ্গবন্ধু তাঁর দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত ছিলেন, কখনও অফিসে, কখনও উনার ছোট্ট নীল সরকারি গাড়িতে, ৩২ নাম্বারে নিজের শোবার ঘরে, বারান্দায়, লনে। কাজ করতে করতে উত্তর দিয়েছেন প্রশ্নের। সময়টা ছিল সোমবার জানুয়ারি ১৭, ১৯৭২।

ডেভিড ফ্রস্টঃ সেই রাতের কথা বলুন। সেই রাত, যে রাতে একদিকে আপনার সাথে যখন আলোচনা চলছিল আর সেই আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল। সেই রাতের কথা বলুন, ২৫শে মার্চ, রাত ৮টা, আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন, সেই বাড়ি থেকেই আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। শুনেছিলাম টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল যে সামরিক বাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করেছে। কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও না যেয়ে গ্রেফতার বরণ করলেন? এই সিদ্ধান্ত কেন? সেই কথা বলুন।

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, সে এক গল্প। সেটা বলা প্রয়োজন। সে সন্ধ্যায় পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী আমার বাড়ি ঘেরাও করে রেখেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ওরা প্রথমে ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে আমাকে হত্যা করে প্রচার করে দেবে যে, আমার সাথে রাজনৈতিক আপস আলোচনার মাঝখানে বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বেরুনো-না বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী বর্বর। আমি জানতাম, আমি আত্মগোপন করলে ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে। তাই স্থির করলাম, আমি মরি ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনি তো কলকাতা চলে যেতে পারতেন।

বঙ্গবন্ধুঃ কলকাতা শুধু নয়, ইচ্ছা করলে আমি যে কোনো জায়গায় যেতে পারতাম, কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা, আমি সংগ্রাম করব, মৃত্যুবরণ করব, পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহবান ছিল, তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলো।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল। কারণ, এই ঘটনাই বিগত নয়মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে তাদের বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত করেছে। তাদের কাছে এখন আপনি প্রায় ঈশ্বরসম।

বঙ্গবন্ধুঃ আমি সেটা বলি না। কিন্তু এটা সত্য তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলাম, তাদের জীবন রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বররা আমাকে সে রাতে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করল। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিলো।

আমার গ্রামের বাড়ি, যেখানে আমার ৯০ বছর বয়সী পিতা আর ৮০ বছরের মাতা ছিলেন, সে বাড়িও ধ্বংস করে দিলো। সৈন্য পাঠিয়ে বাবা-মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে তাদের চোখের সামনে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো, বাবা-মার আর কোনো আশ্রয় ছিল না। ওরা সব কিছুই জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে, জীবনব্যাপী একটি শক্তিশালী সংগঠন আমি গড়ে তুলেছিলাম, জনগণ যার ভিত্তি। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি বলেছিলাম, হয়ত এটাই আমার শেষ নির্দেশ, কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে, লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনাকে ঠিক কীভাবে ওরা গ্রেফতার করেছিল? তখন তো রাত দেড়টা, তাই না? তখন কী ঘটল?

বঙ্গবন্ধুঃ প্রথমে ওরা আমার বাড়ির উপর মেশিগানের গুলি চালিয়েছিল।

ডেভিড ফ্রস্টঃ ওরা যখন এলো আপনি সেসময় বাড়ির কোন জায়গাটাতে ছিলেন?

বঙ্গবন্ধুঃ এখানে, এটা আমার শোবার ঘর, আমি এই ঘরেই তখন বসেছিলাম। (আঙুল তুলে দেখিয়ে) এদিক থেকেই ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে, তারপর এদিক ওদিক সবদিক থেকেই গুলি ছুঁড়তে থাকে, জানালার উপর।

ডেভিড ফ্রস্টঃ এসব তখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, সব ধ্বংস করেছিল, আমি আমার পরিবার-পরিজন এখানেই ছিলাম, ৬ বছরের ছোট ছেলেটি বিছানায় শোয়া ছিল, আমার স্ত্রী দুই সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন।

ডেভিড ফ্রস্টঃ পাকিস্তান বাহিনী কোনদিক দিয়ে ঢুকেছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ সব দিক দিয়ে, ওরা এবার জানালার মধ্য দিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। আমি আমার স্ত্রীকে সন্তান দুটিকে নিয়ে বসে থাকতে বলি, তারপর সেখান থেকে উঠে বাইরে বেরিয়ে আসি।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনার স্ত্রী সেসময় কিছু বলেছিলেন?

বঙ্গবন্ধুঃ না, তখন কোনো শব্দ উচ্চারণের অবস্থা ছিল না, আমি তাকে শুধু বিদায় সম্বোধন জানিয়েছিলাম। দরোজা খুলে বাইরে এসে ওদের গুলি বন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম, তোমরা গুলি বন্ধ করো। আমি তো এখানেই দাঁড়িয়ে আছি, গুলি করছো কেন? তোমরা কী চাও? তখন চারদিক থেকে ওরা বেয়নেট উঁচিয়ে ছুটে এলো, এক অফিসার আমাকে ধরে বলল: এই, ওকে মেরে ফেলো না।

ডেভিড ফ্রস্টঃ একজন অফিসারই ওদের থামিয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, ঐ অফিসারই ওদের থামিয়েছিল। ওরা তখন আমাকে এখান থেকে টেনে নামাল, পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে, বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মারতে লাগল, অফিসারটা আমাকে ধরে রেখেছিল, তবু ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে, টেনে নামাতে লাগল। আমি বললামঃ তোমরা আমাকে টানছ কেন? আমি তো যাচ্ছি। বললাম, আমার তামাকের পাইপটা নিতে দাও। ওরা থামল। আমি উপরে যেয়ে তামাকের পাইপটা নিয়ে এলাম; আমার স্ত্রী তখন ছেলে দুটিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাকে কিছু কাপড়-চোপড়সহ ছোট একটি সুটকেস ধরিয়ে দিলে সেটা নিয়ে নেমে এলাম। চারদিকে দেখলাম আগুন জ্বলছে। আজ এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক এখান থেকে ওরা আমাকে তুলে নিয়ে গেলো।

ডেভিড ফ্রস্টঃ সেদিন যখন ৩২ নাম্বারের আপনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন তখন কি ভেবেছিলেন আর কোনদিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?

বঙ্গবন্ধুঃ না, আমি সেটা কল্পনাও করিনি, মনে মনে ভেবেছি, এই আমার শেষ। আর আজ যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি আত্মসমর্পণ করলে আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, সেটাও ভালো, তবু আমার দেশবাসীর মর্যাদার যেন কোনো হানি না ঘটে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ শেখ সাহেব, আপনি একবার বলেছিলেন ‘যে মানুষ একবার মরতে রাজি, তুমি তাকে মারতে পারো না। কথাটা কি এমন ছিল না?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন, সেটা তার দেহ, কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, কেউ তা পারে না। এটা আমার বিশ্বাস। আমি মুসলমান, মুসলমান একবারই মাত্র মরে, দুবার নয়। আমি মানুষ, আমি মনুষ্যত্বকে ভালোবাসি। আমি আমার জাতির নেতা। আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কোনো দাবি নেই। তারা আমাকে ভালোবেসে সবকিছু বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সব কিছু তাদের দেবার অঙ্গীকার করেছি, আজ তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। যখন আমার প্রতি আমার দেশবাসীর স্নেহ ভালোবাসার কথা ভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।

ডেভিড ফ্রস্টঃ পাকিস্তানি বাহিনী আপনার বাড়ির সবকিছুই লুট করে নিয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, সবকিছুই ওরা লুট করেছে, বিছানা পত্র, আলমারি, কাপড় চোপড় সবকিছুই লুট করেছে। মিঃ ফ্রস্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন এ বাড়ির কোনো কিছুই আজ নেই।
ডেভিড ফ্রস্টঃ আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয়, তখন এসব লুট হয়েছে না পাকিস্তানীরা করেছে?

বঙ্গবন্ধুঃ পাকিস্তানি ফৌজ সবকিছুই লুট করেছে। কিন্তু, এই বর্বর বাহিনী আমার আসবাব-পত্র, কাপড়-চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্য সামগ্রী লুট করেছে তাতে আমার দুঃখ নেই, আমার দুঃখ ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুন্ঠন করেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দিনলিপি ছিল, একটা সুন্দর লাইব্রেরি ছিল, বর্বররা আমার প্রত্যেকটি বই আর এই মূল্যবান দলিলপত্র লুণ্ঠন করেছে। সব কিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আবার তাই একই প্রশ্ন চলে আসে, কেন ওরা লুঠতরাজ চালিয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ এর কী জবাব দেওয়া যায়? ওরা তো মানুষ নয়, কতগুলো ঠগ, দস্যূ, উন্মাদ, অমানুষ আর অসভ্য জানোয়ার। আমার নিজের কথা ছেড়ে দিন, তা নিয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, দুই বছর, পাঁচ বছরের শিশু, মেয়েরা, কেউ রেহাই পেলো না, সব নিরীহ মানুষদের ওরা হত্যা করেছে। আমি আপনাকে জ্বালিয়ে দেয়া পোড়া বাড়ি, বস্তি দেখিয়েছি, একেবারে গরিব খেটে খাওয়া মানুষের বাস ছিল এখানে, এসব মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে, আর, ওরা চারদিক থেকে ঘেরাও করে মেশিনগান চালিয়েছে। ভুট্টো সেসময় বলেছিল, মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি তাহলে, একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে পারবে না। এর প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে, তখন আমার অবস্থা হবে সংকটজনক। ভুট্টো আমাকে একথা জানিয়েছিল, ভুট্টোর নিকট আমি অবশ্যই এই জন্য কৃতজ্ঞ।

ডেভিড ফ্রস্টঃ শেখ সাহেব, আজ যদি ইয়াহিয়া খানের সাথে আপনার সাক্ষাৎ ঘটে তাহলে তাকে আপনি কী বলবেন?

বঙ্গবন্ধুঃ ইয়াহিয়া খান একটা জঘন্য খুনী, তার ছবি দেখতেও আমি রাজি নই, তার বর্বর ফৌজ দিয়ে সে আমার ৩০লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ ভুট্টো এখন তাকে গৃহবন্দী রেখেছে, তাকে নিয়ে ভুট্টো এখন কী করতে পারে? আপনার ধারণা কী?

বঙ্গবন্ধুঃ মিস্টার ফ্রস্ট, আপনি জানেন আমার বাংলাদেশে কী ঘটছে? শিশু, মেয়ে, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সকলকে ওরা হত্যা করেছে। ৩০ লাখ বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে। কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে এবং লুটপাট চালিয়েছে। খাদ্যের গুদামগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়েছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ এ কথা সঠিক জানেন?

বঙ্গবন্ধুঃ এখনো আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসিনি, আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছে, সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড তো নিরর্থক, মানুষকে ঘর থেকে টেনে এনে হত্যা করা।

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, ওরা কাদের হত্যা করেছে? একেবারে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষকে, গ্রামের মানুষকে, যে মানুষ পৃথিবীর কথাই হয়ত শোনেনি, সেই গ্রামে পাখি মারার মতো গুলি করে পাকিস্তানিরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আমার মনেও প্রশ্ন, আহ্‌ কেন এমন হলো?

বঙ্গবন্ধুঃ না, আমিও জানি না, আমিও বুঝি না, পৃথিবীতে এমন ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।

ডেভিড ফ্রস্টঃ এটা তো মুসলমানের হাতেই মুসলমান হত্যা ছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ ওরা নিজেদের মুসলমান বলে? অথচ হত্যা করেছে মুসলমান মেয়েদের, আমরা অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি, আমাদের ত্রাণ শিবিরে এখনও অনেকেই আছে, এদের স্বামী, পিতা সকলকে হত্যা করা হয়েছে। মা আর বাবার সামনে ওরা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, পুত্রের সামনে মাকে। আপনি চিন্তা করুন? আমি একথা কল্পনা করে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না, এরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে কীভাবে? এরা তো পশুরও নীচে। মনে করুন আমার বন্ধু মশিয়ুর রহমানের কথা। আমাদের দলের একজন শীর্ষপর্যায়ের নেতা ছিলেন তিনি, সরকারের একজন প্রাক্তন মন্ত্রীও ছিলেন, তাঁকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ দিন ধরে তাঁর উপর নির্যাতন চলেছে, প্রথমে তাঁর এক হাত কেটেছে, তারপর আরেকটা, এরপর কেটেছে কান, তার পা কেটেছে, ২৪ দিন ব্যাপী তারঁ উপর নির্যাতন চলেছে (এ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু কেঁদে দেন)। কিন্তু এটা একটা মাত্র ঘটনা নয়, আমাদের কত নেতা আর কর্মী, বুদ্ধিজীবী আর সরকারি কর্মচারীকে জেলখানায় আটক করে দিনের পর দিন অত্যাচার করে হত্যা করেছে। এমন অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনী আমি ইতিহাসে কোথাও শুনিনি। একটা পশু, একটা বাঘও তো মানুষকে হত্যা করলে এমন ভাবে করে না।

ডেভিড ফ্রস্টঃ ওরা আসলে কী চেয়েছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ ওরা চেয়েছিল আমাদের বাংলাদেশকে উপনিবেশ করে রাখতে। আপনি তো জানেন মিস্টার ফ্রস্ট, ওরা বাঙালি পুলিশ, বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। ওরা বাঙালি শিক্ষক, অধ্যাপক, প্রকৌশলী, ডাক্তার, যুবক, ছাত্র সবাইকে হত্যা করেছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আমি শুনেছি যুদ্ধের শেষ দিকেও ঢাকাতে ওরা ১৩০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে।

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, আত্মসমর্পণের মাত্র একদিন আগে। কেবল ঢাকাতেই ১৩০ নয়, ৩০০ জনকে ওরা হত্যা করেছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। কারফিউ দিয়ে মানুষকে ঘরে আটকে রেখেছে, এরপর বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে খুঁজে বের করে হত্যা করেছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ তার মানে, কারফিউ জারি করে সকল ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে এসকল হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে?

বঙ্গবন্ধুঃ হ্যাঁ, তাই করেছে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ শেখ সাহেব, আপনার কি মনে হয় ইয়াহিয়া দুর্বল চরিত্রের লোক যাকে অন্যরা খারাপ করেছে না সে নিজেই একটা খারাপ লোক?

বঙ্গবন্ধুঃ আমি মনে করি সে একটা নরাধম। ও একটা সাংঘাতিক মানুষ। ইয়াহিয়া যখন প্রেসিডেন্ট, তখন আমার জনসাধারণের নেতা হিসাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনার সময়ই তা দেখেছি।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আমাদের আজকের এই আলাপে আপনি নেতা এবং নেতৃত্বের কথা তুলেছেন, আপনার কাছে যথার্থ নেতৃত্বের সংজ্ঞা কী?

বঙ্গবন্ধুঃ আমি বলব একটি সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যথার্থ নেতৃত্ব তৈরি হয়, কেউ হঠাৎ একদিনে নেতা হতে পারে না, তাকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে, মানুষের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হবে, তার আদর্শ থাকতে হবে, নীতি থাকতে হবে। এই সব গুণ যার ভেতর থাকে সেই কেবল নেতা হতে পারে।

ডেভিড ফ্রস্টঃ ইতিহাসের কোন নেতাদের আপনি স্মরণ করেন, প্রসংসা করেন?

বঙ্গবন্ধুঃ স্মরণীয় অনেকেই, বর্তমানের কারো কথা বলছি না।

ডেভিড ফ্রস্টঃ না, বর্তমানের কেউ নয়, কিন্তু ইতিহাসের কারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?

বঙ্গবন্ধুঃ আমি আব্রাহাম লিংকনকে স্মরণ করি। স্মরণ করি মাও সে তুং, লেনিন, চার্চিলকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডিকেও আমি শ্রদ্ধা করতাম।

ডেভিড ফ্রস্টঃ মহাত্মা গান্ধী?

বঙ্গবন্ধুঃ মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষ বসু, সহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক, কামাল আতাতুর্ক এদের জন্য আমার মনে গভীর শ্রদ্ধা রয়েছে। আমি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী নেতা ডঃ সুকর্ণকে শ্রদ্ধা করতাম। এরা সবাই তো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসেছিলেন।

ডেভিড ফ্রস্টঃ আজ এই মুহূর্তে, অতীতের দিকে তাকিয়ে আপনি কোন দিনটিকে আপনার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন বলে মনে করেন? কোন মুহূর্তটি আপনাকে সবচাইতে সুখী করেছিল?

বঙ্গবন্ধুঃ যেদিন শুনলাম আমার বাংলাদেশ স্বাধীন, সেই দিনটিই ছিল সবচাইতে সুখের।

ডেভিড ফ্রস্টঃ এই দিনের স্বপ্ন কবে থেকে দেখতে শুরু করেন?

বঙ্গবন্ধুঃ অনেকদিন যাবৎ আমি এই স্বপ্ন দেখে এসেছি।

ডেভিড ফ্রস্টঃ স্বাধীনতার সংগ্রামে আপনি কবে প্রথম কারাগারে যান?

বঙ্গবন্ধুঃ জেল গমণ শুরু হয় সম্ভবত ১৯৪৮ সালে। এরপর ১৯৪৯ সালে গ্রেফতার হয়ে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। ১৯৫৪ সালে মন্ত্রী হই আবার ১৯৫৪তেই গ্রেফতার হয়ে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। আবার ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান আমাকে জেলে পাঠায়, তখন পাঁচ বছর আটক থাকি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সহ নানা মামলায় সরকার আমার বিচার করেছে। ১৯৬৬ সালে আবার আমাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তিন বছর আটক রাখা হয়। এরপর ইয়াহিয়া খান গ্রেফতার করে। এমন দীর্ঘ সংগ্রাম শুধু আমার নয়, আমার বহু সহকর্মীর জীবনে একই ইতিহাস।

ডেভিড ফ্রস্টঃ মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, পৃথিবীর মানুষের জন্য আপনার কাছ থেকে কোনো বাণী আমি বহন করে নিয়ে যেতে পারি?

বঙ্গবন্ধুঃ আমার একমাত্র প্রার্থনা, বিশ্ব আমার দেশের মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসুক। আমার হতভাগ্য দেশবাসীর পাশে এসে দাঁড়াক। আমার দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছে তেমন আত্মত্যাগ খুব কম দেশের মানুষকেই করতে হয়েছে। মিস্টার ফ্রস্ট, আপনাকে আমি আমার একজন বন্ধু বলে গণ্য করি। আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনি এদেশে আসুন, নিজের চোখে দেখুন, আপনি নিজের চোখে অনেক কিছুই দেখেছেন, আরো দেখুন। আপনি এই বাণী বহন করুন যে সকলের জন্যই আমার শুভেচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি, আমার দেশের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে বিশ্ব এসে দাঁড়াবে। আপনি আমার দেশের বন্ধু, আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। জয়বাংলা।

ডেভিড ফ্রস্টঃ জয়বাংলা। আমিও বিশ্বাস করি, বিশ্ববাসী আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে, আপনার পাশে এসে আমাদের দাড়াঁতে হবে নয়তো ঈশ্বর আমাদের কোনোদিন ক্ষমা করবেন না।